তারিখ: ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা সমতা ও বৈষম্যহীনতার অধিকার, গ্রেফতার-আটকে সাংবিধানিক সুরক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাস্থ্য অধিকার আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ঢাকা, ৪ নভেম্বর ২০২৫:
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ৫৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় বক্তারা মৌলিক অধিকারসমূহের কার্যকর বাস্তবায়ন ও সংস্কারের মাধ্যমে সেগুলোর সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, সংবিধানের মূল ভিত্তি—সমতা ও বৈষম্যহীনতা—শুধু আদালতের মাধ্যমেই নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়েও বাস্তবায়িত হওয়া জরুরি।
“সংবিধানিক অধিকার ও প্রতিকার: ধারাবাহিকতা, সংস্কার ও সম্ভাবনা” শীর্ষক এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর. সি. মজুমদার অডিটরিয়ামে। অনুষ্ঠানে আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সংবিধানের মৌলিক অধিকার, সমতা, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে মতবিনিময় করেন।
সমতা ও বৈষম্যহীনতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক সাইমী ওয়াদুদ বলেন, সমতার নীতিকে বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী রায় আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক জুলা গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, কিন্তু সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনায় তা এখনো পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য ইতিবাচক বৈষম্যের (affirmative action) পরিসর বাড়ানো জরুরি। একইসাথে আইন সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নীতি-আলোচনায় বৈচিত্র্যময় কণ্ঠস্বরের অন্তর্ভুক্তিও অপরিহার্য।
ব্যক্তিগত আইন ও সংবিধানের সর্বোচ্চতার প্রশ্ন
আইনজীবী ও লেখক মিল্লাত হোসেন বলেন, যদিও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানকে ঘোষণা করা হয়েছে, বাস্তবে ব্যক্তিগত আইন অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে, যা আইনের দৃষ্টিতে সমতার নীতি ক্ষুণ্ণ করছে।
তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধানে সমানাধিকারের নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে বৈষম্য বিদ্যমান। ১৯৭২ সালের সংবিধানে কেবল “বাঙালি” জাতিসত্তার উল্লেখ এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনের ফলে আদিবাসী, দলিত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, “আমাদের এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, যেখানে প্রত্যেকে সৎভাবে ও গর্বের সঙ্গে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে পারে।”
স্বাস্থ্য অধিকার ও জবাবদিহিতা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, যদিও স্বাস্থ্য অধিকার এখনো মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, এটি সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির আলোকে এবং জীবনের অধিকারের বিচারিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে।
তিনি ড. মহিউদ্দিন ফারুকী বনাম বাংলাদেশ মামলার উল্লেখ করে বলেন, এই মামলায় হাইকোর্ট জীবন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। একইভাবে জরুরি চিকিৎসা সেবা ও অঙ্গ দান সম্পর্কিত বিভিন্ন মামলার রায় স্বাস্থ্য অধিকারকে আরও শক্তিশালী করেছে।
তিনি আরো বলেন, “সকলের জন্য সমঅধিকারভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কার্যকর ও প্রয়োগযোগ্য আইন প্রণয়ন জরুরি।”
গ্রেফতার, আটক ও সাংবিধানিক সুরক্ষা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, সংবিধান গ্রেফতার ও আটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করলেও বাস্তবে তা প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়। এর অন্যতম কারণ হলো ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ৫৯ ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর নির্বিচার প্রয়োগ, যা পূর্বসতর্কতামূলক আটক (preventive detention) করার সুযোগ দেয়। ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলা ও সাইফুজ্জামান মামলায় সুপ্রিম কোর্ট গ্রেফতারের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে নির্দেশনা দিয়েছে, যা অনেকটাই সাম্প্রতিক সংশোধনী আইনে প্রতিফলিত হয়েছে।
ড. ইকবাল জোর দিয়ে বলেন, “আমাদের জাতীয় আইনগুলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সাথে, বিশেষ করে নির্যাতনবিরোধী সনদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।”
চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
লেখক ও সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ বলেন, সংবিধান প্রণয়নের শুরু থেকেই চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিফলিত করলেও, একই সাথে ক্ষমতা ব্যক্তি কেন্দ্রীক করার প্রবণতা তৈরি করে এবং একদলীয় আধিপত্যের ঝুঁকি বাড়ায়। অনুচ্ছেদ ৭০-এর সমালোচনা করে বলেন, এটি সংসদ সদস্যদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে, ফলে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র দুর্বল হয়েছে।
তিনি জানান, কমিশনের সাম্প্রতিক সংস্কার প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—
- আদালতের রায় সমালোচনার অধিকার স্বীকৃতি,
- জরুরি অবস্থাতেও মৌলিক অধিকার সুরক্ষা,
- আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত সম্পত্তির স্বীকৃতি, এবং
- সকল জাতিসত্তা ও ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান।
সংবিধানিক অধিকার সম্প্রসারণ
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবিধানিক সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. শরীফ ভুইয়া বলেন, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান নিয়ে জনপর্যায়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তা অভূতপূর্ব। তিনি জানান, কমিশনের প্রতিবেদনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসহ সমতার অধিকারের সম্প্রসারণ বিষয়ে বিশদ সুপারিশ করা হলেও তা এখনো রাজনৈতিক আলোচনায় প্রতিফলিত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে হাইকোর্টে চলমান অনুচ্ছেদ ১১৬, ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কিত মামলাগুলো নাগরিক অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, এবং আদালতের মাধ্যমে সংস্কারই দীর্ঘমেয়াদে বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে।
নাগরিক-কেন্দ্রিক সংবিধানের পথে
মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন, সংবিধানে বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জোরপূর্বক উচ্ছেদ প্রতিরোধ, জলবায়ু-সংক্রান্ত অধিকার, সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, এবং জনগণের জন্য সহজ ভাষায় সংবিধান প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সমাপনী বক্তব্যে সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ব্লাস্ট-এর অবতৈনিক নির্বাহী পরিচালক, বলেন যে, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিয়ে গণআলোচনার নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে। তবে তিনি ঘৃণাবাচক বক্তব্যের উত্থান এবং সমতা ও বৈষম্যহীনতার বিরোধী রক্ষণশীল প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার বাস্তবায়নের দাবি তোলাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
যোগাযোগ:
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)
ইমেইল: info@blast.org.bd | ওয়েব: www.blast.org.bd