তারিখ: ৯ই মার্চ ২০২৫

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

সংস্কারের সুপারিশসমূহ আইনে প্রতিফলন দেখতে চান বক্তারা

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, শ্রম বিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ‍্যম সংস্কার কমিশন এর সদস্যদের উপস্থিতিতে ব্লাস্ট আয়োজিত “সংস্কার উদ্যোগ ও জরুরী করণীয়” শীর্ষক মত বিনিময় সভায় নারীদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা, সমতা, ক্ষমতায়ন, নিরাপত্তা ও নি‍র্যাতনমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে আইন সংশোধন, প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের বিষয়ে জোর দেন বক্তারা। ৯ই মার্চ ২০২৫ তারিখে ঢাকার দৃকপাঠ ভবনে এই মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মত বিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, ভু্ক্তভোগীদের আরো ভুক্তভোগী করার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা নিয়ে আমাদের দেশে নির্দিষ্ট কোন নির্দেশিকা নেই, এটি অনলাইন সহিংসতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধ‍র্ষণ একটি ঘৃণিত অপরাধ, স‍র্বক্ষেত্রে এর যথাযোগ্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যৌতুক আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা সহজ করতে হবে। বিশেষ বিবাহ আইন, অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য বিষয়ক আইনে সংশোধন জরুরী। ভুক্তভোগীদের গোপনীয়তা, ভার্চুয়াল আদালতের চ‍র্চার উপরে আমাদের কাজ করা উচিত। অনেক সময় দেখা যায় আইনে থাকলেও তার বাস্তবায়ন নাই তাই আমাদের আইন বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। মোরাল পুলিশিং যে অপরাধ তা আইনে প্রতিষ্ঠিত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়াও বক্তারা আরো বলেন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং চা বাগানে বেশিরভাগ নারীরাই কাজ করে। এ জনগোষ্ঠীকে আইন বিষয়ে সচেতন করার জন্য জেলা, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় উদ্যেগ গ্রহণ করা উচিত। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতে যে পুরুষতান্ত্রিকতা রয়েছে তা দূর করা জরুরী। আদিবাসী নারীদের আদালতে প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধির জন্য দোভাষীর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দুর্গম পাহাড়ী এলাকার নারীরা হেল্পলাইন সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই, আশ্রয়সস্থলে তাদের অপ্রতুল নিরাপত্তা, অপর্যাপ্ত স্যনিটেশনের ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রবাসী ক‍র্মজীবী নারীদের সুরক্ষার জন্য আইন সংশোধনে জরুরী। সকল কর্মক্ষেত্রে মাতৃকল্যাণ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও শিশু নি‍র্যাতন দমন আইনের আওতায় বিধি প্রনয়ণ করে বিভিন্ন বিষয় স্পষ্টিকরণ জরুরী।

এছাড়াও বক্তারা বলেন, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করার সময় এসেছে। বিভিন্ন আন্ত‍র্জাতিক চুক্তিসমূহে অনুস্বাক্ষর করার এখনোই উপযুক্ত সময়। ধর্ষনের ভুক্তভোগীদের হাসপাতালে দেরীতে আসার কারণে অনেক সময় ডাক্তার কোন ফাইন্ডিংস পান না এবং রিপোর্টেও তা লিখা হয়, এ সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ সেবা চালু করতে হবে। নার্সদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে ভুক্তভোগীদের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

সংবাদমাধ্যমে নারীদের চাকুরী খুবই ঝুকিপূ‍র্ণ। মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা পেতে তাদের প্রতিবন্ধকতা বেশি। এ ব্যাপারে গণ-মাধ্যমের নীতি-নির্ধারকদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, সকল কাঠামোর মধ্যে শ্রমিকেরা খুবই ঝুকিপূর্ণ তার মধ্যে আরো ঝুকিপূর্ণ নারী এবং প্রান্তিক নারী। দীর্ঘসময় ধরে কারখানায় কাজ করলেও মাতৃত্বকালীন সময়ের জন্য অনেক সময় চাকরিচ্যুত হন অথবা নতুনভাবে কোন চাকরি পায়না। সে প্রেক্ষিতে শ্রম সংস্কার কমিশন থেকে আমরা সুপারিশ করবো যেন, কমপক্ষে ছয়মাস পর্যন্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি সকল ক‍র্মক্ষেত্রের নারীরা ভোগ করতে পারেন এবং চাকুরির সুরক্ষা পান। কমিউনিটি ভিত্তিক নাগরিক সুবিধার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।

শিরীন পারভীন হক বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে আমরা সেভাবে তালিকা দিচ্ছি পাশাপাশি পরব‍র্তীতে নি‍র্বাচিত সরকার যেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং নারী অধিকার বাস্তবায়ণের যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা দী‍র্ঘদিন ধরে কাজ করছি তা বাস্তবায়নের সুপারিশমালা আমরা পৃথক পৃথক ভাবে দিচ্ছি।

সারা হোসেন বলেন, সংস্কার সুপারিশমালা নিয়ে জুডিশিয়ারির সাথে আলোচনা জরুরী পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ও প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে আমাদের গুরুত্বের সাথে কাজ করা জরুরী।

ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেনের সভাপতিত্বে মত বিনিময় সভায় আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান শিরীন পারভীন হক, শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। সেইসাথে আরো উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তাসলিমা ইয়াসমীন ও অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন এর সদস্য ডঃ মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাাডভোকেট ডঃ সিনথিয়া ফরিদ, দলিত নারী ফোরাম প্রজেক্ট অফিসার তামান্না সিং বাড়াইক, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন এর সদস্য সুমাইয়া ইসলাম, নিরূপা দেওয়ান ও কামরুন নাহার। স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন এর সদস্য প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক, শ্রম সংস্কার কমিশন সদস্য এডভোকেট এ কে এম নাসিম এবং ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। মত বিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন ব্লাস্টের উপদেষ্টা (মিইল ও সোশ্যাল জাস্টিস এন্ড ইনক্লুশান ক্লাস্টার) আহমাদ ইব্রাহীম।

উল্লেখ্য, গত ১৮ জানুয়ারী এবং ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ তারিখে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় ব্লাস্ট কমিশনের নিকট খসড়া সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন এবং পরব‍র্তীতে ৮ মা‍র্চ নারী বিষয়ক কমিশনের নিকট লিখিত সুপারিশমালা প্রদান করেন। এর মধ্যে রয়েছে—বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুত নিষ্পত্তি, প্রান্তিক নারীদের জন্য আদালত ও থানায় প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামো, আদিবাসী ও রোহিঙ্গা নারীদের জন্য বিশেষ আদালত, এবং ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের জন্য আইনি সহায়তা, পরিবহন ও হটলাইন সেবা। ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়ন, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সংক্রান্ত মামলায় গোপনীয়তা রক্ষা, ও শিশু অভিভাবকত্ব আইন সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে প্রসূতি সুবিধা বৃদ্ধি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, এবং নিরাপত্তা ও শিশু কক্ষের সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে ট্রাইব্যুনাল সংখ্যা বৃদ্ধি, পুলিশকে ডিজিটাল অপরাধে প্রশিক্ষণ, ও তথ্য সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা প্রশিক্ষণ, ট্রমা সেন্টার স্থাপন, এবং বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমে নারীদের নেতৃত্ব বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে ব্লাস্টের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভার মাধ্যমে ব্লাস্টের প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহ শ্রম সংস্কার কমিশনের নিকট প্রদান করে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার প্রয়োগ, শ্রম আদালতসমূহে “আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০” কার্যকরীকরণ, আদালত অবকাঠামো শ্রম বান্ধব করা, শ্রমিকের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, পেশাগত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, ব্যবসা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা সমূহ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন, দুর্যোগকালীন সময়ে শ্রমিকদের আইনগত অধিকার নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরসনের জন্য যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরসনে “অভিযোগ কমিটি” গঠন ও অভিযোগ কমিটির কাজ সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন, নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা জোরদারকরণ ও জনসচেতসতা তৈরি করা, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বই প্রদানের প্রক্রিয়া সুষ্ঠু তদারকিকরণ।

গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় ব্লাস্ট প্রতিনিধি সুপারিশমালা নিয়ে একটি উপস্থাপনা পেশ করেন। এ সুপারিশমালায়- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামোর পর্যালোচনা ও তা সংস্কার, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার, গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা, গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও তাদের অধিকার, কল্যাণ, আর্থিক সহায়তা এবং আইনি সুরক্ষা, গণমাধ্যম স্ব-নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ও পরিধি, গণমাধ্যম সংস্থাগুলোতে সমতা এবং বৈষম্যহীনতা নীতি প্রতিষ্ঠা করা, বিচারিক কার্যক্রমে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশগম্যতা, প্রতিবেদন কিংবা প্রচারের ব্যাপারে নির্দেশনা, তথ্যে প্রবেশাধিকার, সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন:

কমিউনিকেশন বিভাগ,

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)

ই-মেইল: communication@blast.org.bd