গৃহকর্মীদের নীরব কান্না: নীতির প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতার নিষ্ঠুরতা

আফরিদা সামিহা নাবিলাহ্‌,

সহকারী গবেষক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)

Originally posted in আজকের পত্রিকা on 18 April 2024

দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয়া রাহিমা, মায়ের সাথে বেড়ে উঠেছে রাজধানীর ভাষানটেক বস্তিতে। একদিন এলাকার পরিচিত বাড়ির কর্ত্রী রাহিমার মাকে বলেন তার বাড়ির কাজকর্মে সাহায্যের জন্য একজন কমবয়সী মেয়ের প্রয়োজন। অভাবের তাড়নায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে অপারগ মা, সংসারে কিছু আয় হবার কথা ভেবে মেয়ে রাহিমাকে কাজে পাঠাতে রাজি হন। মাত্র ১১ বছরের রাহিমা নিজ বাসা ছেড়ে, অন্যের বাড়ির সব কাজ করতে শুরু করে।

কাজ শুরুর কিছুদিন পর থেকেই রাহিমা গৃহকর্তার আচরণে অনিরাপদ ও ভীত অনুভব করতো। ঘর পরিষ্কার করার সময় গৃহকর্তা রাহিমাকে জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরা, ঘুমিয়ে থাকলে গায়ে হাত দেয়া সহ নানারকম যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করে। স্বামীর আচরণ সম্পর্কে গৃহকর্ত্রীকে জানানো হলে তিনি রাহিমাকে চুপ থাকার নির্দেশ দেন। তবে গৃহকর্তার বাজে আচরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে, রাহিমা তার মাকে জানান। রাহিমার মা গৃহকর্ত্রীর সাথে এবিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি রাহিমাকে তার বাড়িতে আর কাজে রাখবেন না বলে জানিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে তিনি মেয়েকে নিয়ে আসেন। জীবিকার তাড়নায় রাহিমার মা এরূপ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মেয়ের যত্ন নিতে পারেননি বরং অল্প কিছুদিনের মাথায় পুনরায় অন্য বাড়িতে কাজে পাঠিয়ে দেন।

রাহিমা ১৬ বছর বয়সে মায়ের ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করে নেন। তবে বিয়ের বিষয়ে তার মতামত কেউ জানতে চায়নি। বছরখানেকের মধ্যে রাহিমা অন্তঃসত্ত্বা হন এবং তখনও গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সন্তান প্রসবের কাছাকাছি সময়ে রাহিমা ভারী কাজ করতে অস্বস্তি অনুভব করার কারণে সপ্তাহখানেকের ছুটি চান। তবে তার গৃহকর্ত্রী ছুটি নেওয়ার অনুমতি দেননি এবং ছুটি নিলে কাজ হারাবার সম্ভাবনা আছে বলেন। এতে ভয় পেয়ে রাহিমা ছুটি ছাড়াই কাজ চালিয়ে যান।

একদিন কাজের ফাঁকে রাহিমার মনে পড়ে সে এ বাড়িতে কাজ শুরু করার পর শুনেছে গৃহকর্ত্রী তার কর্মস্থল থেকে ৪ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন। রাহিমা তখন ভাবেন, কেবল অফিসে চাকুরি করলেই এমন ছুটি পাওয়া যায়, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এরকম ছুটি নিয়ে কেউ ভাবেনা। কিন্তু রাহিমা জানেন না যে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান [অনুচ্ছেদ ২৭] এবং সকল জবরদস্তি শ্রমও দন্ডনীয় অপরাধ [অনুচ্ছেদ ৩৪]।

দুর্ভাগ্যবশত, গৃহকর্মীদের সমস্যা সমাধান, সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের দেশে কোন বিশেষ আইন নেই। এমনকি, দেশের শ্রম আইনেও তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯৬১ সালে প্রণীত গৃহকর্মী নিবন্ধন অর্ডিন্যান্সে বাসায় কাজ করা কর্মীদের নিবন্ধনের কথা বলা হলেও, বাস্তবে এই আইনের কোন প্রয়োগ নেই। ২০১৫ সালে প্রণীত “গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি” কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ফাউন্ডেশন ফর ল’ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহান আরা হক-এর যৌথ রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট উক্ত নীতিটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ ও ‘অস্পষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

রাহিমার ঘটনার বিশ্লেষণ এ নীতিমালার অসম্পূর্ণতা উন্মোচিত করে। ১১ বছর বয়সে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করা রাহিমা নীতিমালায় নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের (হালকা কাজের ক্ষেত্রে ১২ বছর) চেয়ে কম। কিন্তু নীতিমালায় কম বয়সী শিশুদের নিয়োগের বৈধতা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। শ্রম আইনে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুদের নিয়োগকে শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য করা হলেও, গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কেন ১২ বছরকে সর্বনিম্ন বয়স ধরা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।

রাহিমার মত বহু গৃহকর্মী প্রতিনিয়ত কাজের সময় নানাবিধ সহিংসতার শিকার হন। নীতিমালা অনুসারে, নিয়োগকর্তার কাছে যৌন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরা প্রচলিত আইনানুযায়ী বিচার পাবেন এবং সরকার তাদের মামলার খরচ বহন করবে। তবে, এ অভিযোগ কোথায় করবেন সে বিষয়ে কোন নির্দেশিকা নেই। শুধুমাত্র একটি মনিটরিং সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে যেখানে গৃহকর্মীরা টেলিফোন, মৌখিক বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবেন।

উক্ত মনিটরিং সেলের গঠন এবং কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের বক্তব্যে জানা যায়, যে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল নীতিমালা বাস্তবায়ন তদারকির জন্য গঠন করা হয়েছিল তা ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটি বৈঠকও করতে পারেনি। ফলে, নির্যাতিত গৃহকর্মীদের পক্ষে তাদের অভিযোগ দাখিল করা এবং বিচার পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত। এছাড়া গৃহকর্মীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত হবার কারণে তাদের পক্ষে প্রচলিত আইন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে বিচার চাওয়া অনেকটাই দুস্কর। নীতিমালায় তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন আদালত কিংবা সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া উল্লেখ থাকা জরুরী ছিল।

গৃহকর্ত্রী রাহিমাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জন্য কাজ থেকে বের করে দেন। নীতিমালা অনুসারে, গৃহকর্মীকে চাকুরি থেকে অপসারণের এক মাস আগে নোটিশ দিতে হবে এবং তাৎক্ষণিক বরখাস্তের ক্ষেত্রে এক মাসের অগ্রীম মজুরি দিতে হবে, যা রাহিমা পান নি। তবে এই বিধি লঙ্ঘন করলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।

নীতিমালায় উল্লেখ আছে যে, গৃহকর্মীরা বেতনের সুবিধাসহ ১৬ সপ্তাহের  (প্রসবের পূর্বে ৪ সপ্তাহ, পরে ১২ সপ্তাহ অথবা গৃহকর্মীর সুবিধা অনুসারে) প্রসূতিকালীন ছুটি পাবেন। উক্ত ক্ষেত্রে রাহিমা এরূপ ছুটির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তবে নীতিমালায় এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া গৃহকর্মী কোন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানাবে সেবিষয়ে কোন ধারনা দেয়া নেই।

নীতিমালাটির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ- গৃহকর্মীদের ন্যূনতম মজুরি, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ও পদ্ধতি এবং গৃহকর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ব্যপারে কোন নির্দেশনা নেই। একইসাথে নীতিমালার অবশিষ্ট বিধি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সরকারপক্ষ থেকে তৎপরতার অভাব লক্ষণীয়। হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর দায়েরকৃত জনস্বার্থ মামলায়, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ৬ মাসের মধ্যে নীতিমালা অনুযায়ী সারাদেশে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে মনিটারিং সেল গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন মহামান্য হাইকোর্ট। এ নির্দেশনার পরও উক্ত সেলসমূহ গঠনে কোন তৎপরতা দেখা যায় নি।

গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষার জন্য আইনের দাবি বহুদিনের। রাহিমা দেশের অসংখ্য গৃহকর্মীর বর্তমান দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। হাইকোর্টের নির্দেশমালার আলোকে, নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। নীতিমালার অসম্পূর্ণতা দূর করে এটিকে আইনে রূপান্তরিত করাও জরুরি। গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং গৃহকর্মকে একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সময়ের দাবি।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এ লেখায় উল্লেখিত রাহিমা চরিত্রটি কাল্পনিক।