The main article was published in Ajker Patrika. Here is the link.

‘যখন আমাদের প্রমোশনের (পদোন্নতি) প্রক্রিয়া চলছিল, ঠিক সে সময়টাতেই আমার এডিটেড কিছু ছবি অফিসজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অফিসে গিয়ে আমি কানাঘুষা শুনতে পাই, প্রত্যেকে সে ছবি নিয়ে আলোচনা করছেন। কয়েক মাস আমি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারিনি।’ কথাগুলো বলছিলেন সরকারি একটি দপ্তরের এক নারী কর্মকর্তা। তিনি জানান, প্রায় এক বছর আগের ঘটনা এটি। এখনো তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। দোষীদের শনাক্ত করতে এবং তাদের শাস্তি দিতে আইনের আশ্রয় নিতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু সে প্রক্রিয়াটা খুব জটিল মনে হওয়ায় এবং পরিবারের সদস্যদের পরামর্শে তিনি বিষয়টি নিয়ে আইনি পথে হাঁটেননি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আমি কোনো প্রতিকার পাইনি। সবাই আমাকে হেয় করেছে।’

শুধু এই নারীই নন, পরিসংখ্যান বলছে, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সাইবার জগতে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বাড়ছে। গৃহিণী, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, কবি ও লেখক, সরকারি কর্মকর্তা, ক্রীড়া ব্যক্তিত্বসহ সব স্তরের নারীই এর শিকার হচ্ছেন।

সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন প্ল্যাটফর্ম বলছে, যাঁরা সাইবার জগতে সহিংসতার শিকার হন, তাঁদের ৭৬ শতাংশই হলো নারী।

এই প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে সংঘটিত নারী ও শিশু সহিংসতার প্রতিকার ও প্রতিরোধে কাজ করছে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) উদ্যোগে গঠিত এই প্ল্যাটফর্মে ব্র্যাক, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনসহ (সিক্যাফ) মোট ১৪টি সংগঠন রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তাদের পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ডিজিটাল মাধ্যমে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেল ও যৌন হয়রানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে অশ্লীল ছবি তৈরি এবং অনলাইনে সহজ ও বাধাহীনভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ও ভিডিও ছড়িয়ে বহু স্তরভিত্তিক অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। ৭০ শতাংশের বেশি ঘটনায় একসঙ্গে ধর্ষণ, ভিডিও ধারণ, ব্ল্যাকমেল ও ডিজিটাল কনটেন্ট ছড়ানোর মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা মনীষা বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সাইবার সহিংসতার ক্ষেত্রে ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট ছড়ানো এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর (এআই) নগ্ন ছবি তৈরি করে তা দিয়ে ব্ল্যাকমেল করার প্রবণতা বেশি। আশঙ্কাজনকভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ভিডিও ধারণ করেও ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে।’

সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন প্ল্যাটফর্ম বলছে, সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়াদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। গৃহিণী ২০ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া বিক্রয়কর্মী, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মী ও ব্যবসায়ী ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।

মনীষা বিশ্বাস জানান, সাইবার জগতে সহিংসতার শিকার বেশির ভাগ নারীই প্রতিকার পান না বা প্রতিকার চান না। এর কারণ হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা জানেনই না যে কোথায়, কীভাবে প্রতিকার চাইতে হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিকার পাওয়ার পদ্ধতিটা জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং সেখানেও হয়রানি হওয়ায় আশঙ্কা থাকে বলে ভুক্তভোগীরা সেখানে যান না।

পুলিশ সদর দপ্তরের ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ প্রযুক্তির প্রভাবে সংগঠিত নারীর প্রতি সহিংসতা অর্থাৎ সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের অভিযোগ গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এ সেবাটি প্রদানকারী সবাই নারী পুলিশ সদস্য। তাঁদের তথ্য বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০টি নতুন মেসেজ (খুদে বার্তা) এবং ৫০-৬০টি কল আসে দেশের নানা প্রান্তের সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে। অধিকাংশ ভুক্তভোগীই আইনগত ব্যবস্থা হিসেবে জিডি (সাধারণ ডায়েরি) বা মামলা করতে আগ্রহী হন না। ফলে সেবা প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত কিছু ছবি ও মেসেজ (খুদে বার্তা) ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আমি যখন থানায় অভিযোগ করতে গেলাম, তারা প্রিন্টেড কপি চাইল। অর্থাৎ আমাকে সেগুলো কোনো দোকান থেকে প্রিন্ট করাতে হবে। যেখানে আমি প্রিন্ট করাতে যাব, সেখান থেকে সেগুলো নতুন করে ছড়িয়ে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?’

এমন প্রেক্ষাপটে আজ থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই পক্ষ পালন করে থাকে। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের এবারের প্রতিপাদ্য, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করি’।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সাইবার সহিংসতা শুধু ভুক্তভোগী নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়; বরং সামগ্রিক সামাজিক নৈতিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও বিপর্যস্ত করছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বিপজ্জনক ইঙ্গিত।