২০ আগস্ট ২০২৫
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
বীরাঙ্গনাদের ব্যক্তিপর্যায়ের প্রয়োজনীয়তাকে পর্যালোচনা করে ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন, প্রতিকার ও প্রতিদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে বক্তারা মতপ্রকাশ করেন, সংগ্রাম থেকে ন্যায়বিচার: বাংলাদেশের ইতিহাস, মানবাধিকার ও ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচার সংক্রান্ত গোলটেবিল বৈঠকে।
২০ আগস্ট ২০২৫ তারিখ, ঢাকাস্থ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে সংগ্রাম থেকে ন্যায়বিচার: বাংলাদেশের ইতিহাস, মানবাধিকার ও ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচার শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের বীরাঙ্গনা ও বিশ্বের অন্যান্য সংঘাতকালীন যৌন সহিংসতায় ভুক্তভোগী নারীদের অভিজ্ঞতা, আইনি পরিস্থিতি ও প্রতিকারমূলক ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা হয়। মূলতঃ বীরাঙ্গনাদের ন্যয়বিচারের পথে যাত্রা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যৌন সহিংসতার শিকার নারী বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন শীর্ষক একটি গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয় এ অনুষ্ঠানে। প্রফেসর বীণা ডি’কস্টার পরিচালনায় ব্লাস্ট এবং নারীপক্ষের যৌথ উদ্যোগে গবেষণাতে অবদান রাখেন ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, আইন গবেষক তাকবির হুদা, গবেষণা কর্মকর্তা ইসরাত জাহান সিদ্দিকী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ-এর খন্ডকালীন শিক্ষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান, নারীপক্ষের সদস্য ডঃ ফিরদৌস আজিম এবং নারীপক্ষের আন্দোলন সম্পাদক সাফিয়া আজিম, সহ আরো অনেকে।
REDRESS-এর অর্থায়নে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও নারীপক্ষ যৌথভাবে ১৯৭১ এর বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিয়ে গবেষণা কাজটি পরিচালনা করেন। এতে গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘাত-সম্পর্কিত যৌন সহিংসতার (CRSV) শিকার ‘বীরাঙ্গনা’ নারীদের অভিজ্ঞতা, ক্ষতিপূরণের বর্তমান অবস্থা এবং তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা চিহ্নিত করা। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে, বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকারি স্বীকৃতি ও সুবিধা থাকলেও প্রক্রিয়ার জটিলতা, সামাজিক কলঙ্ক এবং প্রশাসনিক বাধার কারণে অনেকেই যথাযথ প্রতিকার ও সুরক্ষা পান না। গবেষণাটি তাই ভুক্তভোগীকেন্দ্রিক একটি ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন কাঠামো প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।
গবেষণার প্রেক্ষিতে উক্ত আলোচনায় সংঘাত জনিত যৌন সহিংসতা ও ক্ষতিপূরণের অধিকার: ইতিহাস থেকে শিক্ষা শীর্ষক উপস্থাপনা পেশ করেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর বীণা ডি’ কস্টা। তার উপস্থাপনায় বীরাঙ্গনা, Conflict Related Sexual violence (CRSV) ও বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনগত কাঠামো এবং এ ব্যপারে সুপারিশসমূহ তুলে ধরেন। তিনি মূলত: বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ, প্রতিকার, পুনর্বাসন ও প্রতিদানের অধিকার এবং এ নারীদের সাথে CRSV-র শিকার অন্যান্য ভুক্তভোগীদের মধ্যে আন্তঃপ্রজন্মীয় সংলাপ করার ব্যপারে জোর দেন।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, রাষ্ট্র ধর্ষণের ভুক্তভোগী নারীর অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে নিজের শাস্তি প্রয়োগের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে আন্তঃপ্রজন্মীয় প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে বীরাঙ্গনাদের পরিবারের সন্তান বা নাতী-নাতনীদের কোটার ব্যবস্থা এবং এ নারীদের নিয়ে সচেতনতা বা স্মৃতিচারণ বৃদ্ধি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা উঠে আসে। সেই সাথে বীরাঙ্গনাদের পরিচিতি তৈরি করার জন্য সরকারি স্মারক প্রকাশ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে তাদের প্রয়োজন কী তা পর্যালোচনা করে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়ার ব্যপারে মতামত প্রদান করেন।
নারীপক্ষের সদস্য এবং আন্দোলন সম্পাদক সাফিয়া আজিম বলেন, আমরা আমাদের এ গবেষণায় ভাষাগত দিকটি নিয়ে বিশ্লেষণ করি। মুক্তিযুদ্ধের যে বক্তব্যটি সবথেকে বেশি প্রচলিত “দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা” এ বক্তব্যকে পরিবর্তন করে আমরা বলতে চায় “দুই লক্ষ নারীর ধর্ষনের ভুক্তভোগীর মাধ্যমে আমাদের এ স্বাধীনতা”। আমাদের গবেষণায় ১০৩ জন বীরাঙ্গনাদের সাথে কথা হয়, যার মধ্যে কেবল ৫৩ জন নারী বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক দলীল, সাক্ষী গ্রহণের মতো কঠোর প্রক্রিয়টি একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া বীরাঙ্গনা যারা আছেন তারা নিজেদের বীরাঙ্গনা পরিচয় দিতে ইতস্তত বোধ করেন বিভিন্ন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। উপরন্তু, এ জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কেউ ক্ষতিপূরণ পানও, পারিবারিক বিভিন্ন টানাপোড়নের কারণে তারা এ ক্ষতিপূরনের সুবিধা নিজেরা ভোগ করতে পারে না। আমরা এর থেকে উত্তরণের জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছি, যার মধ্যে অন্যতম হলো তাঁদের নিয়ে বীরাঙ্গনা নেটওয়ার্ক তৈরি করা।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, আমরা যখন Conflict Related Sexual violence (CRSV) এর গবেষণা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করি তখন কেবল মুক্তিযুদ্ধ নয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নানান ধরনের সহিংসতাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যেমন, উর্দুভাষী নারীদের উপর সহিংসতা, পার্বত্য অঞ্চলে নারীদের প্রতি সহিংসতা। বাংলাদেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের তুলনায় ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি অনেকটা বেশি কার্যকর। বীরাঙ্গনাদের বিচারের যাত্রাটির মধ্যে সব থেকে দেখার বিষয় হলো কতদিন পরে এ বিষয়গুলো আমাদের সামনে আসছে। টোকিও ট্রাইব্যুনালে প্রিয়ভাষিণী বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে এ ব্যপারে গুরুত্বটাকে বোঝাতে সাহায্য করে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ বলে যে, এ নারীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতের জন্য আলাদা করে কোন কিছু বলার এখতিয়ার রাখে না। যার ফলশ্রুতিতে হাইকোর্ট বিভাগের একটি জনস্বার্থ মামলার রায়ে গেজেটের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি এবং ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে এ রায় বা দিকনির্দেশনা স্বর্তেও এখনো অনেকে এ স্বীকিৃতি পাননি, পেলেও তাদের যে সুযোগ-সুবিধা তা এখনো তাদের কাছে পৌছেনি। এক্ষেত্রে এ সংঘাত সম্পর্কিত নারীদের নিয়ে টেকসই ব্যবস্থার জন্য “ধর্ষণ” সংজ্ঞাকে সংশোধন করা, এ নারীদেরকে সংলাপে বসতে উৎসাহিত করা এবং স্মৃতিচারণ খুবই জরুরী বলে মনে করি।
মানবাধিকার আইনজীবী এবং আইনি গবেষক তাকবির হুদা বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যদি দেখা হয় তাহলে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ফৌজদারী মামলার সাথে জড়িত। অথচ আমরা দেখি ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ মামলার রায় হয়। সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি দুরূহ এবং জটিল হয়ে যায়, যা আসলে শুধুমাত্র বীরাঙ্গনা নয় সকল নারীর জন্য একটি হতাশাজনক ব্যপার। এ সংক্রান্ত বিষয়ে ব্লাস্টের একটি গবেষণায় বিভিন্ন রায়ের মধ্যে আমরা দেখতে পারি যে, আদালত ক্ষতিপূরন “নারীর সম্মান হানি”-র জন্য দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আদালত রেপারেশনের দৃষ্টিতে এ প্রতিকারগেুলো প্রদান করা হয় না। বীরাঙ্গনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারকে স্বীকার করে আমাদের এ নারীদের ক্ষতিপূরনের কথা বলতে হবে।
লেখক ও গবেষক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, ভুক্তভোগী কেন্দ্রিক ন্যায়বিচারের অন্যতম দিক হলো “নীরবতা ভাঙ্গা”। অনেক সময় দেখা যায়, ভুক্তভোগীরা তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তেমন কিছু বলতে চান না। আর সেই নীরবতাই অনেক সময় একটি ভিন্ন ধরণের নির্যাতনে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে আইনী পরিবর্তনের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার আনাও জরুরী। রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের কথা বলে আমরা ক্ষতিপূরণকে ফৌজদারী আইনে অন্তর্ভুক্ত করলে তা কতখানি ফলপ্রসূ হবে, তা ভেবে দেখার বিষয়। সংঘাত সম্পর্কিত যে নির্যাতনের কথা বলা হলে ক্রান্তিকালীন ন্যয়বিচারের সংঘাতগুলোর উপরেও আলোকপাত করা উচিত। ন্যায্যতার যে দাবী, তা নিশ্চিতে যে ফাঁকগুলো রয়েছে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করাও জরুরী। এ ব্যাপারে আরও গবেষণা ও জানার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বৈঠকে সঞ্চালনা ও সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন। আলোচক হিসেবে সভায় উপস্থিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক বীণা ডি’কস্টা, নারীপক্ষের সদস্য ও আন্দোলন সম্পাদক সাফিয়া আজিম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং ব্লাষ্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, মানবাধিকার আইনজীবী এবং আইনি গবেষক তাকবির হুদা, লেখক এবং গবেষক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা।
উল্লেখ্য, CRSV ভুক্তভোগীদের জন্য সরাসরি প্রশাসনিক ক্ষতিপূরণ প্রদান কর্মসূচী চালু করা, বীরাঙ্গনাদের অধিকারকে আইনগতভাবে সুরক্ষিত করা এবং স্মৃতিচর্চা ও স্বীকৃতিমূলক উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ উঠে আসে গবেষণাতে। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করা, ভুক্তভোগীদের সংহতি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ, বীরাঙ্গনা ও অন্যান্য CRSV/লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে আন্তঃপ্রজন্মীয় সংলাপকে উৎসাহিত করা এবং ধর্ষণ আইন সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের দাবি জোরদার করার কথাও উল্লেখ করা হয় গবেষণার সুপারিশে।
বার্তা প্রেরক:
কমিউনিকেশন বিভাগ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)
ই-মেইল: communication@blast.org.bd
