তারিখঃ ১২ মে, ২০২৫

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আইন প্রণয়ন এবং শাসন কাঠামো নির্ণয় আবশ্যক – নাগরিক সংলাপে বক্তারা

আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধান অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্ব রয়েছে; এবং দেশের পরিবেশ আদালতের কার্যক্রম বিস্তৃত করে তা আরোও জোড়দার করা প্রয়োজন। ব্লাস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনায় বক্তারা এ বিষয়ে আলোকপাত করেন।

১২ মে ২০২৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কনফারেন্স রুমে “জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান ও অর্থায়ন: রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও বাস্তবতা” শীর্ষক আলোচনা যৌথভাবে আয়োজন করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং আইন অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বহুমাত্রিক আলোচনায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয় এবং জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অর্থায়ন ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাখিলকৃত উপস্থাপনাগুলোর সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ — সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার পক্ষে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে । বাংলাদেশ ‘সাধারণ কিন্তু পৃথকীকৃত দায়িত্ব এবং নিজস্ব সক্ষমতা’ (Common But Differentiated Responsibilities and Respective Capacities Approach) পদ্ধতির বাস্তবায়নের প্রধান প্রবক্তা। বাংলাদেশ “loss and damage” তহবিল ​​বরাদ্দের শক্তিশালী সমর্থক এবং গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মাধ্যমে জলবায়ু অর্থায়নের অন্যতম বৃহত্তর প্রাপক। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনি দায়িত্ব সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)-এ তার “উপদেশমূলক অভিমত” (Advisory Opinion) উপস্থাপনা (submission) করেছে।

এ আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ডিন, আইন অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, বাংলাদেশের আইন প্রণয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রাথমিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আন্তঃপ্রজন্মগত ন্যায়বিচারের ধারণাটি তুলে ধরে তিনি সংবিধানে এটি অন্তর্ভুক্ত করার বিশ্বব্যাপী প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি আন্তঃপ্রজন্মগত ন্যায়বিচারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলো তদারকি করার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একজন কমিশনার নিয়োগের জন্য সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের উল্লেখ করেন।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে “উপদেশমূলক অভিমত” জন্য আইসিজের কাছে বাংলাদেশের উপস্থাপনার সারসংক্ষেপ এ আলোচনায় উপস্থাপন করেন এডভোকেট মৌমিতা দাস গুপ্ত এবং এডভোকেট সৈয়দ তানভীর আজম তাইফ। বাংলাদেশ ১৮টি মূল দেশের একটি যারা ICJ-এর জন্য প্রশ্নমালা প্রণয়নে অংশগ্রহণ করে। ২০২৪ সালে রাষ্ট্র পক্ষগুলো লিখিত এবং মৌখিক উভয় ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করে।বর্তমানে বিচারিক পর্যালোচনার প্রক্রিয়া চলছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব সম্পর্কে চূড়ান্ত পরামর্শমূলক অভিমত ২০২৫ সালের মধ্যে প্রদান করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অভিমতটি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জলবায়ু ব্যবস্থা রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রগুলোর কর্তব্য এবং এই বাধ্যবাধকতাগুলোর পূরণ করতে ব্যর্থতার আইনি পরিণতি সম্পর্কে স্পষ্টতা চায়।বাংলাদেশ তার লিখিত এবং মৌখিক দাখিলপত্রে নির্গমন প্রশমন এবং জলবায়ু অভিযোজনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি (তার জাতীয়অভিযোজন পরিকল্পনার মাধ্যমে) জোর দিয়েছিল এবং ন্যায্য শক্তি স্থানান্তর নিশ্চিত করার জন্য ধনী, উন্নত এবং জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলির দায়িত্বের উপর জোর দিয়েছিল।

অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ, ঢাকা, ড. মাসরুর সালেকিন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান আইনী ও বিচারভিত্তিক কার্যকারিতা এবং যথোপযুক্ততা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু-সম্পর্কিত নীতিমালা এবং কর্মপরিকল্পনা রয়েছে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন আইনের অভাব রয়েছে, যার ফলে দৃশ্যমান নীতিগত অপর্যাপ্ততা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে দুটি পরিবেশ আদালত রয়েছে, তবে মামলার সংখ্যা খুবই কম। ভ্রাম্যমাণ আদালত দূষণের জন্য শিল্পগুলোকে জরিমানা করে, তবে এই জরিমানা প্রায়শই উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি ছাড়াই পরিশোধ করা হয়। পরিবেশগত লঙ্ঘনের জন্য দেশের আরও শক্তিশালী আইন এবং বৃহত্তর জবাবদিহিতার প্রয়োজন। বিশেষত, জলবায়ু নিয়ে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা দরকার।

সৈয়দ মতিউল আহসান, উপদেষ্টা-জলবায়ু, রয়্যাল ডেনিশ দূতাবাস দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক জলবায়ু অর্থায়নে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ন্যাপ, এনডিসি, ডেল্টা প্ল্যান এবং জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার মতো বিস্তৃত জলবায়ু পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে কর্মক্ষেত্র এবং সূচক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে, অনেক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা প্রায়শই দাতা-চালিত হয়, দাতাদের অগ্রাধিকার মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সম্পূর্ণ সরকারের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক মোঃ শামসুদ্দোহা জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও প্রশমন প্রক্রিয়া বিষয়ে ‘সাধারণ কিন্তু পৃথক দায়িত্ব’ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক অবস্থানের আলোকে বাংলাদেশের প্রশাসনের আলোচনা করেন। তিনি বলেন, UNFCCC (জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের কাঠামো কনভেনশন) আইনত বাধ্যতামূলক নয়, এবং দেশগুলি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, যেমনটি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। কনভেনশনের অধীনে কিয়োটো প্রোটোকল বাধ্যতামূলক, কিন্তু প্রয়োগকারী ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। উন্নত দেশগুলি তহবিল প্রদান করে (যেমন, COP-এর সময় বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের অনুরোধ করার পরে $১০০-২০০ মিলিয়ন), তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য আইনত অর্থ প্রদান করতে হবে না। বাংলাদেশের ঐতিহাসিকভাবে কম নির্গমন সত্ত্বেও, এটি তার NDC (জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান) এর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এটি আপডেট করার পরিকল্পনা করছে।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু নিয়ে স্বল্প কিছু জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছে, যেমন সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিয়ে। কিন্তু এ মামলায় তেমন ইতিবাচক ফলাফল দেখা যায় নি। মূলত, আন্তর্জাতিক দায়িত্ব জাতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব হিসেবে সরাসরি পরিণত হয় না। জলবায়ু পরিবর্তন এর ফলাফলে স্থানচ্যুতি, জলাবদ্ধতা, উষ্ণতা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিশ্চিত করা উচিত। জলবায়ু ন্যায্যতা নিয়ে সর্বসাধারণের কথা বলা দরকার যেন নিজ অবস্থান থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা যেতে পারে।

এ আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন ব্লাস্টের উপদেষ্টা আহমদ ইব্রাহীম

উল্লেখ্য যে, ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে, আইসিজে জলবায়ু প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো বহুপাক্ষিক চুক্তি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সর্বজনীন বাধ্যবাধকতার (universal obligations) বিষয়ে একটি উপদেশমূলক অভিমত(Advisory Opinion) উপর আলোচনা করছে, যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UNGA) কর্তৃক জলবায়ু ব্যবস্থা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষতির আইনি পরিণতি, যার মধ্যে বহির্দেশীয় প্রভাব এবং আন্তঃপ্রজন্মগত সমতা অন্তর্ভুক্ত, সম্পর্কিত প্রশ্নের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ইতোপূর্বে, ভানুয়াতুর নেতৃত্বাধীন একটি মূল রাষ্ট্রগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে বাংলাদেশও এই প্রশ্নমালা প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।