২৪ অক্টোবর ২০২৪

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ:

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ নিরসনে তরুণী ও তরুণদের নেতৃত্ব প্রয়োজন এবং বাল্যবিবাহ নিরোধের জন্য সরকারি বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যা, যা একইসাথে নারীদের প্রতি বৈষম্যের একটি উৎস এবং ফলাফল। বাল্যবিবাহের প্রভাব রোধ করতে তরুণী এবং তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের কে বিভিন্ন সরকারী পরিকল্পনায় যুক্ত করা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর উদ্যোগে আজ ২৩শে অক্টোবর ২০২৪ তারিখ ডেইলি স্টার সেন্টার, ঢাকা-তে আয়োজিত “বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ: পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ নিরসনে তরুণদের ভূমিকা ও করণীয়” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এই দাবিসমূহ তোলেন, যেখানে বাল্যবিবাহের প্রভাব রোধে তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।

মূল উপস্থাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, প্রফেসরিয়াল ফেলো, অর্থনীতি বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখ করেন যে  বিগত দশকের অর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ২০১৭ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের প্রবর্তন সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ হার কমাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি এখনও সন্তোষজনক নয়।  নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনও বিশ্বে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে যেখানে বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক। সাম্প্রতিক বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বৈষম্য হ্রাস এবং সামাজিক পরিবর্তনে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহ নিরসনের জন্য নতুন, সৃজনশীল উদ্যোগের প্রয়োজন যা কেবল আইনি ব্যবস্থা এবং শাস্তি নির্ধারণে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং চলমান প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতেও কাজ করবে। এ বিষয়ে, ড. আসাদুল্লাহ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ১০৯ হেল্পলাইনের উদ্যোগ কার্যকর করতে এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ কর্মকান্ডে তরুণ-তরুণীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার এবং এনজিওগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের উপর জোর দেন।

অভিজ্ঞতা বিনিময়ে কমিউনিটি সদস্য রাবেয়া বছরি তানহা বলেন, “নিজের অভিজ্ঞতায় বলি, আমার মনে হয় নারীরা যদি তাদের জায়গা থেকে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অসম্ভব নয়”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ হতে সহকারী সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, “পরিবারের সদস্যরা বাল্যবিয়ের ফলে মেয়েদের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি স্বামীর বাড়িতে তাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার দিক, তাদের ভবিষত নিশ্চিত করতে শিক্ষার্জনের নিশ্চয়তার দিকটি বিবেচনা করছেন না।   সচেতনতা সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য পরিবার ও সমাজকে একই সাথে কাজ করতে হবে”।

মোবাস্সারা করিম মিমি, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ বলেন “স্কুল কলেজ পর্যায় থেকেই বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। একজন শিক্ষার্থী কেন ক্লাসে আসছে না বা সে তার পরিবারের দিক থেকে কি ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন তা নিয়ে যথাযথ যোগাযোগ বজায় রাখলে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকেই বাল্যবিবাহের বিপক্ষে সচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব।”

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ নিরসনে তরুণ ও তরুণীদের ভূমিকা ও করণীয় বিষয়ে ড. সাজেদা আমিন বলেন; “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাল্যবিবাহ নিরসনে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার ইতিবাচক দিক নিয়েও তিনি বক্তব্য রাখেন। তিনি আরও বলেন , আইনি বিধান এবং এ সংক্রান্ত সচেতনতার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।”

বাল্যবিবাহ নিরসনে তরুণদের ভূমিকা স্বর্ণকিশোরী প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা ফারজানা ব্রাউনিয়া বলেন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে গেলে নানাবিধ ঝুঁকি থাকে। সামাজিক সুরক্ষার অভাব বাল্য বিয়ের অন্যতম কারণ।

ব্র্যাক এর প্রজেক্ট ম্যানেজার এডভোকেট মিতালী জাহান বলেন “বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা বাল্যবিবাহ নিরসনে অনেক পদক্ষেপ গ্রহন করলেও তার আশানুরূপ ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তথ্য থাকলেও তাঁরা এ বিষয়ে কতটা সচেতন তা নির্ণয় করা প্রয়োজন”

হালিমা খাতুন, প্যারালিগ্যাল, সেফ প্লাস, “ব্লাস্ট বাল্যবিবাহ নিয়ে সমাজের পুরুষ সদস্যদের নেতিবাচক মনোভাবের ব্যাপারেও উল্লেখ করেন। বাল্যবিবাহ নিরোধে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী এবং পুরুষদের সমন্বয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, অধিকার সচেতনতা, বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি গুরুত্বারোপ করেন।”

ডিয়াকোনিয়া বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর খোদেজা সুলতানা লোপা; বাংলাদেশ উইমেন’স হেলথ কোয়িালিশন (বিডব্লিও এইচসি) এর নিব্াহি পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ মোস্তফা হেলাল মুক্ত আলোচনায় নারীদের অধিকার এর বিষয়ে ব্যাপক প্রচার, নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ, এবং তরুণীদের তরুণদের পাশে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরী করা নিয়ে দাবি জানান এবং তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

সারা হোসেন, অনারারী নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট তাঁর বক্তব্যে বলেন, “আইন এবং অধিকার নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি যদি একজন ব্যক্তিকে সুযোগ তৈরী করে দেয়া না হয় তবে একজন ব্যক্তি তাঁর জীবনধারনের জন্য পথ বেছে নিতে পারবেন না। মেয়েদের জন্য যদি আমরা অধিকার সচেতন করার পাশাপাশি তাদের জন্য সুযোগ করে দিতে পারি তবে তাঁরা শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি জীবনধারণের জন্য চাকুরি কিংবা ব্যবসা বা অন্য যে কোন পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।”

ড. তসলিমা ইয়াসমীন, সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সভা সঞ্চালনা করেন এবং সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, “বাল্যবিবাহ তরুণদের জন্য একটি হুমকিস্বরূপ। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যে বাল্যবিবাহ নিরসন এবং নারীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়”

প্রেক্ষাপটঃ

মেয়েদের বাল্যবিবাহের চর্চা আমাদের দেশে ধর্ম,বর্ণ এবং শ্রেণী নির্বিশেষে অত্যন্ত প্রচলিত। বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে শিক্ষার অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আইন সম্পর্কে অসচেতনতা, মেয়ে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের নিরাপত্তার অভাববোধ, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক যৌন হয়রানী এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকাই মুলত এই চর্চার জন্যে দায়ী। নারীদের জন্য ১৮ বছরের কম বয়সী বিবাহের ক্ষেত্রে আইনে শাস্তি প্রদানের বিধান আছে, কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানগুলি ইঙ্গিত করে যে প্রায় ৫১% নারীর এই বয়সের পৌঁছানোর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। (ইউনিসেফ রিপোর্ট ২০২১)। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে ব্লাস্ট তার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এ সমস্যা সমাধানের দিক নির্দেশনা নির্ধারনের জন্যই এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছেন।

প্রকল্প পরিচিতি:

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের ঝুঁকি কমানোর জন্য এবং কিশোর-কিশোরী গোষ্ঠীর বিকাশ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ও কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ বাস্তবায়নে গ্লোবাল ইনোভেশন ফান্ড এর আর্থিক সহায়তায় সেইফ প্লাস নামের  এই  প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। দিনাজপুর, ঢাকা, খুলনা এবং পটুয়াখালী জেলা শহরে | এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়িত করা, যাতে তারা তাদের নিজস্ব এবং আশেপাশের এলাকার বাল্যবিয়ের সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে, কিশোর-কিশোরী ক্ষমতায়ন অর্জনের জন্য তাদের প্যারালিগ্যাল প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং অভিজ্ঞ প্যারালিগ্যালদের তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া হবে, কিশোর ও কিশোরী কমিউনিটি ভিত্তিক প্যারালিগ্যাল ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গুলো বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সাথে কিশোর—কিশোরী দলের সংযোগ স্থাপন। প্রকল্পের কার্যক্রম গুলো হল প্রকল্পের অধীনে ৫০ টি কিশোর-কিশোরী দল গঠন করা হবে। কিশোর-কিশোরী দলগুলোকে তাদের নিজস্ব এবং আশেপাশের এলাকার মধ্যে বাল্যবিয়ে এবং কিশোর- কিশোরীদের স্বাধীন কৈশোর, শিক্ষা ও কর্মের সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করার জন্য কার্যক্রম সংগঠিত করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে, যেখানে তরুণী ও তরুণেরা অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে, সেখানে তাঁরা সামাজিক সংস্কার এবং বৈষম্যের মূল উৎস নিরসন, বিশেষ করে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং তার একটি বিশেষ প্রতিফলন ও ফলাফল অর্থাৎ বাল্যবিবাহ  নিরসনে তরুণদের ভূমিকা ও করণীয় নির্ধারণ করাই ছিল এই মতবিনিময় সভার মূল উদ্দেশ্য।

বার্তা প্রেরক:

কমিউনিকেশন বিভাগ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)

ই-মেইল: communication@blast.org.bd

প্রকাশিত সংবাদ সমূহ:

o   বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তরুণদেরও যুক্ত হওয়া উচিত ( Prothom Alo, 24 Oct 2024)

o   বাল্যবিয়ে নিরসনে তরুণদের ভূমিকা রাখতে হবে ( Samakal, 24 Oct 2024)

o   বাল‌্যবিবাহ প্রতি‌রোধ সে‌মিনার- ‘বাল‌্যবিবাহ ব‌ন্ধে আইনসহ নানা উদ্যোগ থাক‌লেও নেই অগ্রগ‌তি’ ( Jugantor, 23 Oct 2024)

o   বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি পরিকল্পনায় তরুণদের সম্পৃক্ত করার আহ্বান ( Ajker Potrika, 24 Oct 2024)

o   Involve the youth in combating child marriage ( Daily Star, 24 Oct 2024)