শুধু নিরাপত্তায় নয় জনগণের সুরক্ষায়ও আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে আরো শক্তিশালী করতে হবে – নিমতলী থেকে বেইলী রোডর অগ্নিকান্ডের বাস্তবতা ও করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এই মতামত ব্যক্ত করেন বক্তারা। পাশাপাশি ভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সংক্রান্ত সনদ (Occupancy Certificate) নেয়কে কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন করা এবং যথাযথ তদারকির মাধ্যমে ঝুকিপূর্ণ ভবনগুলোকে চিহ্ণিতকরে ঝুকিপূর্ণ বলে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে হবে বলে অংশগ্রহণকারীগন ব্যক্ত করেন।
এ ঘটনাগুলোর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও ভুক্তভোগীর পরিবারে এখনো আইনগত প্রতিকার পায়নি বলে তারা বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করার জোর দাবী জানান। আজ ৯ই মার্চ ২০২৪ তারিখ সিরডাপ অডিটোরিয়াম, তোপখানা রোড ঢাকায় অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম-এসএনএফ, সেইফটি এন্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) এর যৌথ সমন্বয়ে নিমতলী থেকে বেইলি রোড: অগ্নিকান্ডের বাস্তবতা ও করণীয় বিষয়ক একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন।
সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্যে বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপীল বিভাগ, সুপ্রীম কোট, বাংলাদেশ বলেন, এই হত্যাগুলোকে অবহেলজনিত হত্যাকান্ড না বলে বেআইনী কার্যক্রমে মাধ্যমে হত্যাকান্ড হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এই হত্যাকন্ডে জড়িত যারা আছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা ও এডভোকেট সুপ্রীম কোর্ট বাংলাদেশ এ ব্যপারে আলোকপাত করে বলেন, ৫-১০ তলা ভবন সর্বসাকুল্যে ১ লক্ষ। এসব উচু ভবন পুরান ঢাকার ক্যামিক্যাল গুদাম এবং এইসব ভবনে কোন নির্দেশিকা মানা হয়নি। আমাদের প্রায়শই জাহাজ ভাঙ্গার শিল্পে এ, বস্তিতে, মার্কেটে আগুন লাগছে। আমাদের সাথে আমদের শিশুরাও ভীত এইরকম পরিস্থিতিতে। নাগরিকদের নিরাপত্তায় তাদের জীবনের অধিকারের আমাদের জন্য জাস্টিস হবে তখনই যখন আমরা যাতে এই স্বস্তিতে ভবনে থাকতে পারি যে নূন্যতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আছে সে জন্য মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ১ লাখ ভবন যদি উচ্চ ঝুকি সম্পন্ন হয় তবে টাস্কফোর্স তৈরী করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য ভবন, মালিক, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকোশলীসহ ডেভেলপারকে কাজে লাগাতে হবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার সাথে পুরো কাজ সম্পন্ন করতে হবে। যাতে কেউ হয়রানির স্বীকার না হয়, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি যেমন নিশ্চিত করত হবে,ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে তেমনি যথাযথ ক্ষতিপূরন দিতে হবে। ব্যাংকগুলো প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে টাকা জমা দিলেও চুড়িহাট্টার কেউ এখনো কোন ক্ষতিপূরণ পায় নি, তার জবাব ও দিতে হবে।
সারা হোসেন, অবৈতনিক নির্বাহি পরিচালক, ব্লাস্ট ও সিনিয়র এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট বাংলাদেশ তার বক্তব্যে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মতে বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন/সক্রিয়করণে রেগুলেটরী অথরিটি গঠনের কথা বলা হলেও অদ্যবধি যথাযথভাবে তা কার্যকর করা হয়নি। এ ভবনগুলো অনুমোদন, তৈরী ও ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা না নিয়ে বিশেষ অভিযানের নামে নির্বিচারে আটক কখনোই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না এবং এ ঘটনাগুলো প্রতিরোধের দিকেও আমাদের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রাণহানি এবং দুর্ভোগের দায় সরকারের নিতে হবে। এবং এ অগ্নিকান্ডে নিহত ব্যক্তিদের স্মরনে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করতে হবে এবং ঘটনার দিনকে শোকবহ দিবস হিসেবে পালন করতে হবে।
ইকবাল হাবিব, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, রাজউকের এক সম্মুখ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ঢাকা শহরে ৫ তলা বা এর কম ভবনের সংখ্যা ৮ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার ভবনের নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু জরিপে উঠে এসেছে, ৯৫ হাজার ভবনের কেবল ৪১৭৫টি ভবনে অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ, ২০২৪-২০২৭ সালের নির্মিত ভবনের ৯৬ শতাংশ ভবন অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেন্দ্রীভুত নগর ব্যবস্থাপনার কারণে এই নগরী জনবহুল এবং অপরিকল্পিত নগরীতে পরিনত হচ্ছে। এমন ভাবে আইনগুলো বিক্ষিপ্ত করা হয়েছে যে কাউকে আলাদাভাবে আইনের আওতায় আনা যায় না এটি মূলত দায় এড়ানোর জন্য করা হয়েছে। ফায়ার ফাইটার এক্ট ২০১৩ সালে প্রনয়ন করা হলেও ফায়ার সার্ভিসের আইনের বিধি-বিধান ২০১৫ সালে ১টি ছোট নোটিশের মাধ্যমে স্থগিত করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এ পর্যাপ্ত পদায়ন করা হচ্ছে না। টাস্কফোর্স তৈরী করে ৬ টি মন্ত্রলয়ায়নের সমন্বয় সাধন করে অবৈধ দালনগুলোকে পরিসীমিত ও যথাযথ করে অনুমোদিত ভবনের আওতায় আনতে সার্টিফিকেট চালু করা এবং তা জনস্বার্থে ভবনের দ্রশ্যমান স্থানে টাঙ্গিয়ে দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট চালু করা হয় এবং তা জনস্বার্থে ভবনের সামনে টাঙিয়ে দেয়ার নিয়ম চালু করা হোক যাতে জনগন নিজে তার সুরক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সাংঘষিকতা দূরীভূত করে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান পিএসসি, বিশেষজ্ঞ, অগ্নি ও দুর্যোগ ঝুকি ব্যবস্থা এবং সাবেক মহাপরিচালক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বা দক্ষতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। মৌলিক যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কথা তা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি কিনা তা যাচাই করা উচিত। ফায়ার সার্ভিসে একই লোক ফায়ার ফাইটিং করছে, এবং প্রশাসনিক কাজ করে এবং তাদের গঠন ও অনেক পুরোনো আমি মনে করি তাদের প্রিভেনটিভ উইংকে আরো শক্তিশালী করতে হবে । ট্রেনিং প্রোগ্রাম, এসেসম্যান্ট, টাস্ক ফোর্স গঠন এবং রেগুলেটরী সংস্থাকে কার্যকর করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ভবনে বহির্গমন পথ ও একটি ছোট টিম রাখা প্রয়োজন যারা এই ধরণের দুর্ঘটনায় আটকে পড়া লোকজনকে বের করার পথ দেখিয়ে দিবে। কারণ প্রথমেই যদি এই উদ্যোগ নেয়া যায় তাহলে দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক কমিয়ে আনা যায়। আমাদের অতিদ্রুত কিছু জনসংযোগের জন্য কিছু উদ্যোগ নিতে হবে এবং আমাদের সকলকে একত্রে উদ্যোগ নিতে হবে।
ড. মো. ইয়াসির আরাফাত খান, সহযোগী অধ্যাপক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বুয়েট বলেন, বছরে প্রায় ২৪০০০ এর মতো অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে এবং এই ঘটনার কারণ গুলো অনেক ক্ষেত্রেই একই। বেসিক ফায়ার প্রটেকশন, অকুপেন্সীর উপর দালনের নিরাপত্তা নির্ভর করে। বেইলী রোডের আগুন দেখলে বুঝা যায় দালানের বহিগমন পথ সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যার কারণে হতাহতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবন কতৃপক্ষ জানমালের নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করেনা বলে দুর্ঘটনাগুলো এত বেশি হচ্ছে। বিজনেস এনটিটি যারা আছে তাদের দায়ী করা যাচ্ছে না এই ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাগুলোকে অধিক জরিমানার আওতায় আনতে হবে।
অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল হক বলেন, ১৯৮৪ সালে অনেকগুলো মহাকুমা ছিল তা জেলায় পরিণত হয় যার কারণে আমাদের জনবলের অভাব আছে। বর্তমানে যে হাসপাতাল গুলো তৈরি করা হচ্ছে সেই হাসপাতাল গুলোতে গুরুতর অসুস্থ ব্যাক্তিদের জন্য কোন বহির্গমন পথ (র্যাম্প) নেই। যার কারণে উৎসুক জনতার ভীরের কারনেও আমাদের আগুন নির্বাপণের সমস্যা হচ্ছে। কারণ সাধারণ মানুষরা জানে না কিভাবে আমাদের সহযোগিতা করবে। আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশ থাকবে ৬ মাস পর পর ভবনের ইলেক্ট্রিক তার গুলীর লোড চেক করতে হবে যাতে করে শর্ট সার্কিট না হয় এবং ওয়াসার প্রতিটি এলাকায় হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করায় গুরুত্ব দিতে হবে যাতে দ্রুত আগুন নেভানো যায়।
পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জনস্বার্থে দায়েরকৃত মামলার হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরেন এডভোকেট আয়েশা আক্তার, এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট বাংলাদেশ, ফাহাদ বিন সিদ্দিক, গবেষণা কর্মকর্তা, ব্লাস্ট এবং এস. হাসানুল বান্না, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও কো-অর্ডিনেটর, লিগ্যাল, বেলা। তাদের বক্তব্যে নীমতলী, চুড়িহাট্টা, হাশেম ফুড ফ্যাক্টরী, তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকন্ডের জন্য দায়ের করা মামলার বর্তমান অবস্থার কথা উঠে আসে। সভায় উক্ত অগ্নিকান্ডের ভুক্তভোগীরাও তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানান সকলকে। সভায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় আন্ত-মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি টাস্ক-ফোর্স তৈরী করার জোর দাবী উঠে আসে। উক্ত মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্য এবং উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের পরিচালক (আইন) মো: বরকত আলী এবং সভায় সমাপনী বক্তব্যে শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি, জন-নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতি বছর জন-নিরাপত্তা নিরিক্ষণ প্রয়োজনীয় বলে মতামত প্রকাশ করেন।
বার্তা প্রেরক
কমিউনিকেশন বিভাগ
আরও তথ্যের জন্য: communication@blast.org.bd