বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ও সমকালের গোলটেবিল আলোচনা

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাক্ষী সুরক্ষা আইন চাই

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচারপ্রার্থী ও সাক্ষীর সুরক্ষা বিষয়ে আইন ও নীতিমালা থাকলেও বাংলাদেশে এমন আইন নেই। মামলা করলে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়; তারা হামলার শিকার হন। এ কারণে ভুক্তভোগী মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন কিংবা সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হন না। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকালের সভাকক্ষে ‘ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন: ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন বিশিষ্টজন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সমকাল এই গোলটেবিলের আয়োজন করে। এতে সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ইউএসএআইডি এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনাল।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. নিজামুল হক এতে সভাপতিত্ব করেন। সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খানের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্লাস্টের উপদেষ্টা (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং) তাজুল ইসলাম, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. কাজী জাহেদ ইকবাল, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপপরিচালক নিগাত সীমা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রুমা সুলতানা, ব্লাস্টের পরিচালক (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মাহবুবা আক্তার এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনালের প্রোগ্রাম সহযোগী কাজী ফারাহবী রহমান ও শাহিনুর আক্তার। ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন (খসড়া) প্রণয়নের লক্ষ্যে করণীয়বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্লাস্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার আয়েশা আক্তার।

 

গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, মানব পাচারের ক্ষেত্রে রুদ্ধদ্বার বিচার না করে বিশেষ আদালতে বিচার করা যেতে পারে। আদালতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের খণ্ডকালীন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক ফান্ড রয়েছে। সরকার থেকে থোক বরাদ্দও দেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আন্তরিক।
আবু সাঈদ খান বলেন, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় সমন্বিত আইন প্রয়োজন। তাদের জন্য প্রয়োজনে ‘সেফ হোম’-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শুধু নারী ও শিশু নয়; পুরুষও এ ধরনের অপরাধের ভুক্তভোগী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পুরুষদেরও সেফ হোমে রাখতে হবে। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের বাড়ি থেকে শুরু করে সব জায়গায় সুরক্ষা দিতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান অন্যান্য আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে এই আইন প্রণয়ন করতে হবে।

রেজাউল করিম বলেন, অনেক মামলায় ভুক্তভোগীরা আসামিদের তুলনায় কম শক্তিশালী হওয়ায় নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। দেখা যায়, চার্জশিটে উল্লেখ করা সাক্ষীরা আসামিদের হামলার ভয়ে সাক্ষ্য দিতে আদালতে যেতে পারেন না। অনেক সময় বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগী মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন। তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আইন প্রণয়ন করে সঠিক প্রয়োগ করলে এমন পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।

তাজুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশে এ বিষয়ে আইন ও নীতিমালা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে আইন কমিশন প্রথম এ বিষয়ে একটা প্রস্তাবনা দেয়। এতে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার কথা বলা হয়। পরে এ প্রস্তাবনা সংশোধন করা হয়। এ ছাড়া অনেক মামলায় আদালত ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। দেখা যায়, ভুক্তভোগীরা আইনগত কোনো সুরক্ষা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে বিচার পাচ্ছেন না।

মূল প্রবন্ধে আয়েশা আক্তার মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২-এর বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নারী ও শিশুদের সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে আইন কমিশনের খসড়াটি তৈরি করা হলেও লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কোনো ব্যক্তিই মানব পাচারের শিকার হতে পারেন। আইন কমিশনের খসড়াতে নারী-পুরুষ-শিশুসহ সব ভিকটিম ও সাক্ষীকে সুরক্ষা প্রদানের বিষয় থাকা উচিত। মানব পাচারের অপরাধ প্রকৃতিগতভাবেই বাংলাদেশের নাগরিক কর্তৃক ভিন্ন দেশে অথবা ভিন্ন দেশের নাগরিক কর্তৃক বাংলাদেশে অথবা বাংলাদেশের নাগরিক কর্তৃক ভিন্ন দেশের নাগরিকের ওপর সংঘটিত হতে পারে। তাই আইন কমিশন এবং এমজেএফের খসড়া দুটিতে অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগের বিধান রাখা উচিত। খসড়া দুটি বিশেষ ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতের জন্যও বিবেচনা করা প্রয়োজন। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীদের সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে রুদ্ধ-কক্ষ বিচারের বিধান রাখা যেতে পারে। আইন কমিশনের খসড়াতে ২০১২-এর আইন এবং এমজেএফের খসড়ার আলোকে এরূপ বিধান রাখা উচিত। আইন কমিশনের খসড়াতে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের বিস্তারিত পদ্ধতির বর্ণনা প্রয়োজন। ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে ভিকটিমের আর্থিক ক্ষতি ও আয় উৎপাদন সক্ষমতার ক্ষতিকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আইন কমিশনের খসড়াতে ভিকটিম ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় তহবিল গঠনের ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

সভাপতির বক্তব্যে মো. নিজামুল হক বলেন, সাক্ষী সুরক্ষা আইন অবশ্যই দরকার। তবে এ আইন করতে গেলে এটা বিবেচনা করতে হবে যে, সাক্ষী সুরক্ষা মানে কি শুধু সাক্ষ্য দেওয়ার সময় সুরক্ষা, নাকি পরেও সুরক্ষা দেওয়া হবে; কতদিন সেটা দেওয়া হবে। আইনের গভীরতা হিসেবে নিরাপত্তার সময় নির্ধারণ করতে হবে। সব মামলায় যে রায়ের পরেও সুরক্ষা দিতে হবে– বিষয়টা এমন নয়। যেসব মামলায় সাক্ষীদের মামলা-পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকবে, সেটা বিবেচনা করে দিতে হবে। কোনো আইনেই এ বিষয়টি বলা নেই। ক্ষেত্রবিশেষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদেরও নিরাপত্তার বিধান করতে হবে। মামলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে গুরুত্ব বিবেচনা করে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের মামলা-পরবর্তী নিরাপত্তা বিধান করা যেতে পারে।