বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণঃ আইনগত কাঠামো ও প্রতিবন্ধকতা

 

ফাহাদ বিন সিদ্দিক

গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)

Originally posted in স্মৃতি চিরঞ্জীব on April 2024
গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, আপিল বিভাগ রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলা আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে। দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধসে ২০১৩ সালে প্রায় হাজারের উপর শ্রমিক প্রাণ হারায়। এই ঘটনা ইমারত নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতির আড়ালে থাকা এক কঠোর বাস্তবতাকে সামনে তুলে আনে। এই ঘটনার দশ বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মাণ শিল্পে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা এখনও উদ্বেগ সৃষ্টি করার মতো। সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭০০ এর বেশি নির্মাণ শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটেছে। এই উদ্বেগজনক হারে শ্রমিক মৃত্যুর কারণ হিসেবে সচেতনতার অভাব এবং নিরাপত্তাবিধি মেনে চলার প্রতি অনীহাকে দায়ী করা যায়। বিদ্যমান তথ্য স্পষ্টভাবেই নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য তৈরি করা আইনগুলিকে আরও ভালোভাবে প্রয়োগের দাবি জানিয়ে দেয়। কিন্তু দেশে শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২০ এর মত শক্তিশালী আইনি ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও, এগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগে বাধা রয়েছে।
আমার মতে শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার রক্ষায় প্রণীত শ্রম আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি রয়েছে। এ আইনের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো (অধ্যায় ৫ – ৮) মূলত বাতিলকৃত ‘কারখানা আইন, ১৯৬৫’ এর অনুলিপি। ফলে, এই বিধানগুলি কারখানার জন্য উপযোগী হলেও, নির্মাণ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য অনুপযোগী। এছাড়াও ‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর’ শ্রম আইনের ১৩ ও ১৪ অধ্যায় বাদে, বাকি অধ্যায়গুলি প্রয়োগের দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, জনবলের অভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অধিদপ্তর আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগে তেমন কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু দুর্বল আইন প্রয়োগই না, আহত ও নিহত শ্রমিকদের জন্য আইনে বরাদ্দকৃত ক্ষতিপূরণের পরিমাণও হতবাক করার মত নগণ্য।
যদিও শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ শ্রম আইন বাস্তবায়নের পদ্ধতি বর্ণনা করে, কিন্তু হতাশাজনকভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে এটি সীমিত আকারে নির্দেশনা দেয়। বিধি নং ৭৫ নির্মাণকাজে নিরাপত্তা বিধান মেনে চলার কথা উল্লেখ করলেও, নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিবরণ নেই। শ্রম আইনে থাকা ত্রুটিগুলোর বিপরীতে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে, এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে এখনও কিছু বাধা রয়েছে। এই বিধিমালায় বাংলাদেশ ইমারত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের বিধান আছে, যা এর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ গঠন না হওয়ায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে
২০০৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সহ আরও কয়েকটি সংস্থা নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন করতে হাইকোর্ট  বিভাগে একটি রিট দাখিল করে। রায়ে হাইকোর্ট এ বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে এক বছরের মধ্যে বিধিমালা প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ গঠন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোন সরকারি উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না, যার ফলে, ২০১৩ সালে আদালত অবমাননার পিটিশন দায়ের করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট  শ্রম মন্ত্রনালয়, আবাসন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অবমাননার রুল জারি করে। এই রুলের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলি কর্তৃপক্ষ গঠন না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকার বিভাগ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থাকে অস্থায়ীভাবে বিধি প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেয়। কিন্তু এই অস্থায়ী ব্যবস্থাপনার ফলে শ্রমিক নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য বাধা থেকেই যায়। অস্থায়ী বিধি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, যেমন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং জনবলের অভাবে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে
বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এখনও হুমকি মধ্যেই রয়েছে। আইনগত কাঠামো থাকলেও, শ্রম আইনের ত্রুটি এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বাস্তবায়নে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, কিছু বিষয়ে জরুরী সংস্কারের প্রয়োজন। নির্মাণস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য ইমারত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে যেমন সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তেমনি এই কর্তৃপক্ষ গঠনের পর জনবল সরবরাহ করতে হবে। আইন মেনে চলতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়, তবে আইন ও বাস্তবায়নের মধ্যেকার ব্যবধান দূর করতে স্থায়ী প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত জরুরি।

গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, আপিল বিভাগ রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলা আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে। দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধসে ২০১৩ সালে প্রায় হাজারের উপর শ্রমিক প্রাণ হারায়। এই ঘটনা ইমারত নির্মাণ শিল্পের অগ্রগতির আড়ালে থাকা এক কঠোর বাস্তবতাকে সামনে তুলে আনে। এই ঘটনার দশ বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মাণ শিল্পে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা এখনও উদ্বেগ সৃষ্টি করার মতো। সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭০০ এর বেশি নির্মাণ শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটেছে। এই উদ্বেগজনক হারে শ্রমিক মৃত্যুর কারণ হিসেবে সচেতনতার অভাব এবং নিরাপত্তাবিধি মেনে চলার প্রতি অনীহাকে দায়ী করা যায়। বিদ্যমান তথ্য স্পষ্টভাবেই নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য তৈরি করা আইনগুলিকে আরও ভালোভাবে প্রয়োগের দাবি জানিয়ে দেয়। কিন্তু দেশে শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০২০ এর মত শক্তিশালী আইনি ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও, এগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগে বাধা রয়েছে।

 

আমার মতে শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার রক্ষায় প্রণীত শ্রম আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি রয়েছে। এ আইনের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণ সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো (অধ্যায় ৫ – ৮) মূলত বাতিলকৃত ‘কারখানা আইন, ১৯৬৫’ এর অনুলিপি। ফলে, এই বিধানগুলি কারখানার জন্য উপযোগী হলেও, নির্মাণ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য অনুপযোগী। এছাড়াও ‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর’ শ্রম আইনের ১৩ ও ১৪ অধ্যায় বাদে, বাকি অধ্যায়গুলি প্রয়োগের দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, জনবলের অভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অধিদপ্তর আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগে তেমন কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু দুর্বল আইন প্রয়োগই না, আহত ও নিহত শ্রমিকদের জন্য আইনে বরাদ্দকৃত ক্ষতিপূরণের পরিমাণও হতবাক করার মত নগণ্য।

 

যদিও শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ শ্রম আইন বাস্তবায়নের পদ্ধতি বর্ণনা করে, কিন্তু হতাশাজনকভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে এটি সীমিত আকারে নির্দেশনা দেয়। বিধি নং ৭৫ নির্মাণকাজে নিরাপত্তা বিধান মেনে চলার কথা উল্লেখ করলেও, নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিবরণ নেই। শ্রম আইনে থাকা ত্রুটিগুলোর বিপরীতে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে, এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে এখনও কিছু বাধা রয়েছে। এই বিধিমালায় বাংলাদেশ ইমারত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের বিধান আছে, যা এর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ গঠন না হওয়ায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

 

২০০৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) সহ আরও কয়েকটি সংস্থা নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন করতে হাইকোর্ট  বিভাগে একটি রিট দাখিল করে। রায়ে হাইকোর্ট এ বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে এক বছরের মধ্যে বিধিমালা প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ গঠন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোন সরকারি উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না, যার ফলে, ২০১৩ সালে আদালত অবমাননার পিটিশন দায়ের করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট  শ্রম মন্ত্রনালয়, আবাসন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অবমাননার রুল জারি করে। এই রুলের পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলি কর্তৃপক্ষ গঠন না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকার বিভাগ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থাকে অস্থায়ীভাবে বিধি প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেয়। কিন্তু এই অস্থায়ী ব্যবস্থাপনার ফলে শ্রমিক নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য বাধা থেকেই যায়। অস্থায়ী বিধি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, যেমন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং জনবলের অভাবে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

 

বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এখনও হুমকি মধ্যেই রয়েছে। আইনগত কাঠামো থাকলেও, শ্রম আইনের ত্রুটি এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বাস্তবায়নে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, কিছু বিষয়ে জরুরী সংস্কারের প্রয়োজন। নির্মাণস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য ইমারত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে যেমন সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তেমনি এই কর্তৃপক্ষ গঠনের পর জনবল সরবরাহ করতে হবে। আইন মেনে চলতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়, তবে আইন ও বাস্তবায়নের মধ্যেকার ব্যবধান দূর করতে স্থায়ী প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত জরুরি।