প্রেস বিজ্ঞপ্তি

৩০ জুলাই ২০২৩

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক আইন বাতিল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আইন ও নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী  

সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আইন ও নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন “Towards Equality and Inclusion: A Review of Laws and Policies in Bangladesh” শীর্ষক গবেষণার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের অংশগ্রহনকারীগণ। আজ ৩০ জুলাই ২০২৩ তারিখে ঢাকার আগারগাঁওয়ে পর্যটন কর্পোরেশনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে বক্তারা বাংলাদেশের সাংবিধানের আলোকে লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ বা জাতি, জন্মস্থান, নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতকরণে আইন ও নীতির সামঞ্জস্যতা মূল্যায়ন করেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আইনের সম সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে যে সকল বৈসাদৃশ্যতা রয়েছে তা চিহ্নিত করে সরকারি সেবায়, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা এবং আইনগত সহায়তা ইত্যাদিতে তাদের অভিগম্যতা ও অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অসম সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন. দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, হিজড়া এবং ট্রাসজেন্ডার জনগোষ্ঠী আরো প্রান্তিকতার দিকে চলে যায়। যে সকল আইন ও নীতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক তা বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় এবং উক্ত গবেষণা প্রতিবেদনটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব মোঃ শাহরিয়ার আলম। প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন  একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিল যে দেশে কোন  বৈষম্য থাকবে না। অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থা ও প্রতিনিধিত্ব অনেক পরিমাণে বেশি।   আমি সাধুবাদ জানাই গবেষকদের যে, তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে এত গভীর একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সকল প্রান্তিক অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত  করার জন্য বর্তমান সরকার খুবই সচেতন। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস আছে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ দের নিয়ে সহবস্থান করার। আর তাই আমরা দলিত, হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার বা ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তা  জনগোষ্ঠীদের সকল সুবিধা নিশ্চিত করার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি । এই গবেষণা সরকারের সেই লক্ষ্যকে আরও সহজ করবে। তাদের সুপারিশ সমূহ  সরকার বিবেচনায় রাখবে।

বিশেষ অতিথি মাউরিজিও চিয়ান তার বক্তব্যে বলেন, আমরা বাংলাদেশের সরকার কে স্বাগত জানাই সকল নতুন যুগোপযোগী আইন ও পলিসি সংস্কারের জন্য। বৈষম্য বিরোধের সকল প্রচেষ্টাকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সমর্থন করে।

গবেষণার উপর সুপারিশ তুলে ধরেন, গবেষনাপত্রের সহ-সম্পাদক,  ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি অর্জিত সুপারিশসমূহ উল্লেখ করে বলেন, দলিত, হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন  নিয়ে যে কথা উঠে এসেছে, তার অতি সত্তর সমাধান দরকার, পাসপোর্ট  চিকিৎসা জরুরী সেবা পেতে যেন একটুও বিঘ্ন না ঘটে। এইসমস্ত জায়গা গুলোতে আইন সংস্করণ করে এই সকল অসামজ্ঞস্য শব্দের ব্যাবহার কমিয়ে,  তাদের সুব্যাবস্থা পাকাপক্তো করতে হবে। একই সাথে আমাদের সকল নাগরিকের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। তবেই বৈষম্য বিরোধ করা সম্ভব হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সম্মানিত সদস্য মো: আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আইনী সীমাবন্ধতার কারণে অনেকেই চাকুরীতে প্রার্থী হবার সুযোগ পান না।  এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠানের প্যানেল আলোচক সালেহ আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (বন্ধু) বলেন, প্রস্তাবিত ট্রাসজেন্ডার বিলের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীর আলাদা সংজ্ঞা, ভোট দেওয়ার অধিকার, ধর্ষন সম্পর্কিত আইন, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় এবং কর্ম ক্ষেত্রে নিপিড়ন  সহ  বিভিন্ন বিষয়ে সুরক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে। নতুন আইনটি কার্যকারী হলে তবেই আজকের অনেক আলোচনা ফলপ্রসু হবে।

প্যানেল আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক সাইমী ওয়াদুদ, বৈষম্য বিরোধী আইন বা নীতির মাধ্যমে আমরা যে সকল জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে চাই তা এককেন্দ্রিক নয়- তাই  অন্ত:সংযুক্তির মাধ্যমে এর  বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। যে আইনগুলি যৌন সহিংসতা বা যৌন হয়রানিকে মোকাবিলা করে সেগুলিকে নারীদের বাইরে চিন্তা করা উচিত এবং তাদের পরিধির মধ্যে ট্রান্সজেন্ডারদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

প্যানেল আলোচক রুবায়েত ফেরদৌস, সহকারী পরিচালক, (প্রশাসন) সিনিয়র সহকারী জজ, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা বলেন –এখন পর্যন্ত প্রায় ৯লক্ষ মানুষকে সরকারী আইনী সহায়তা প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে কেবল ৪৪ জন ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী আইনী পরামর্শ নিয়েছেন।

গবেষনাপত্রের সহ-সম্পাদক,  ব্লাস্টের  অনারারি নির্বাহী পরিচালক, ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনায় মৌলিক মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল ৭২ সালেই । অর্থাৎ সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি সমতার অধিকারের পরিধি বোঝা প্রয়োজন। এ কারণে সমতা ও বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে শুধু সংবিধান নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও ব্যাখ্যা  ব্যবহার করতে পারি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, সরকারী অংশীজন তাদের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা প্রয়োজন। রাষ্ট্র মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য ।  কোন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি কোন বিদ্বেষমূলক বক্তব্য অবশ্যই নিন্দনীয়, এবং তার ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে,  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে প্রান্তিক ও দরিদ্র ব্যক্তি এমনকি  কিশোর কিশোরীদেরও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

সর্বশেষে, সমাপনী বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগ এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন বলেন, আজকের এই অসাধারণ গবেষণা প্রতিবেদন এর মাধ্যমে আমরা আশা করি আইনকে আরো শক্তিশালী করতে  পারব।  আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে এ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কথা বলেছিল।  যদিও কিছু অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আরও অংশগ্রহণ প্রয়োজন ।

সাংবিধানিক কাঠামোর সামঞ্জস্যতা এবং দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, হিজড়া এবং ট্রাসজেন্ডার জনগোষ্ঠী আইন ও নীতি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিবেদনের মূল ফলাফল  উপস্থাপন করেন ড. সিনথিয়া ফরিদ ও আহমেদ ইব্রাহীম। তারা   ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের ইন্টেরিম কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জেবিন ।

“Towards Equality and Inclusion: A Review of Laws and Policies in Bangladesh” প্রতিবেদনের সম্পাদনায় ছিলেন, ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, সারা হোসেন ও ড. বীণা ডি’কস্টা। এই প্রতিবেদনটি প্রণয়নে ছিলেন আবদুল্লাহ তিতির, আহমেদ ইব্রাহীম, সিনথিয়া ফরিদ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং তাজুল ইসলাম। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সহযোগীতায় ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, নাগরিক উদ্যোগ ও ওয়েব ফাউন্ডেশন কতৃক যৌথভাবে বাস্তবায়িত ’পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ’ প্রকল্পেরে আওতায় গবেষণাটি চারটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় – দলিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী এবং সমতলে ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তার প্রতি বৈষম্যেমূলক আইন-নীতির বিশ্লেষণ করেন। উক্ত চারটি সম্প্রদায়ের সাংবিধানে বর্ণিত অধিকারের আলোকে বর্তমান আইনী কাঠামোর  সামঞ্জস্যতা বিশ্লেষণ করা হয়।